খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি
বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ডে বাংলাদেশ সরকার, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি এবং অন্যান্য দাতাদেশ ও সংস্থার দেওয়া খাদ্য সাহায্য ব্যবহার করা হয়। খাদ্য সাহায্যের মাধ্যমে বান্তবায়িত কর্মসূচিগুলো খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি নামে পরিচিত। বাংলাদেশে যেসব খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি আছে তাহল-
কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি
বিভিন্ন নামে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়ে থাকে। এরমধ্যে অন্যতম কর্মসূচিগুলো হল-
- পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচী (আরডি)
- কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচী (কাবিখা)
- গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার কর্মসূচী
কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির উদ্দেশ্য
পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচী (আরডি) ওয়াটার,রোড,ফিসারিজ ও ফরেস্ট্রি এই চারটি সেক্টরে পরিচালিত হয়। বিভিন্ন নামে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা সংস্থার মাধ্যমে এই কর্মসূচী বাস্তবায়িত হলেও এর প্রধান উদ্দেশ্য হল:
- কাজের সুযোগ তৈরির মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা গড়ে তোলা এবং গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে সহায়তা করা।
- গ্রামের দরিদ্র জনগণের জন্য সম্পদ সৃষ্টি করা।
- প্রকল্পের উপকার ভোগীদের আয় বাড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণ,ঋণ প্রদান,সঞ্চয় এবং সমাজের সমর্থনে তাদের নিজের পায়ে দাঁড় করানো।
প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির কাজ
কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) রয়েছে। এই কমিটি যেসব কাজ করে:
- প্রকল্পের মাপ গ্রহণ এবং হিসাব-নিকাশ ও নথিপত্র তৈরি ও সংরক্ষণ করে এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি ও দাতা সংস্থার কর্মকর্তাকে চাহিদামাত্র প্রকল্প সংক্রান্ত সকল হিসাব-নিকাশ ও নথিপত্র দেখায়।
- প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্প কমিটির চেয়ারম্যান এবং সদস্যবৃন্দ একক এবং যৌথভাবে প্রত্যেকেই দায়ী থাকেন। প্রকল্প কমিটির প্রত্যেক সভার কার্যবিবরণী লিপিবদ্ধ করা হয় এবং তাতে উপস্থিত প্রত্যেক সদস্যের স্বাক্ষর থাকে। প্রতিমাসে প্রকল্প কমিটির সভা বসে।
- প্রকল্প কমিটির চেয়ারম্যান নিজে বা তার মনোনীত প্রতিনিধি মারফত গম/চাল উত্তোলন, যথাযথভাবে সংরক্ষণ ও তা শ্রমিকদের মধ্যে ন্যায্যভাবে বিধি অনুসারে বিতরণের জন্য দায়ী থাকেন।
- প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের মাধ্যমে ইউনিয়ন পরিষদের নিকট এবং ইউনিয়ন পরিষদ উপজেলা কর্তৃপক্ষ ও জনগণের নিকট দায়ী থাকে।
- প্রথম কিস্তির গম/চাল উত্তোলনের সময় প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির চেয়ারম্যান ও সেক্রেটারি গম/চালের সুষ্ঠু ব্যবহারের জন্য এক চুক্তিনামা স্বাক্ষর করেন এবং তা ১৫০ টাকার ননজুডিশিয়াল স্টাম্পে সম্পাদন করা হয়।
- প্রকল্প এলাকায় সাইনবোর্ড টাঙ্গানোর ব্যবস্থা করা হয় এবং তাতে খাদ্যের পরিমাণ, বিতরণের তারিখ ও উপকারভোগীর সংখ্যা উল্লেখ থাকে।
ভিজিডি কর্মসূচি
খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার বিভিন্ন স্তরের উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের উপজেলাগুলোকে খুব বেশি খাদ্য নিরাপত্তাহীন, বেশি খাদ্য নিরাপত্তাহীন, মাঝারি খাদ্য নিরাপত্তাহীন এবং কম খাদ্য নিরাপত্তাহীন এমন চারটি ভাগে ভাগ করা হয়।
ভিজিডি মহিলা নির্বাচন
- ইউপি সদস্যগণ প্রাথমিক তালিকা প্রণয়ন করেন।
- ইউনিয়নের নির্বাচিত তিনজন মহিলা সদস্য ওই ইউনিয়নের মোট বরাদ্দকৃত কার্ডের ৫০% এর প্রাথমিক তালিকা প্রণয়ন করেন।
- নয়টি সাধারণ আসনের পুরুষ সদস্য বাকি ৫০% কার্ডের প্রাথমিক তালিকা চেয়ারম্যানের পরামর্শক্রমে তৈরি করেন।
- ইউপি ভিজিডি কমিটি প্রাথমিক তালিকা পর্যালোচনার পর চূড়ান্ত করে ইউএনও’র নিকট দাখিল করে।
- উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ও উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা যৌথভাবে সঠিকতা যাচাই করেন।
- উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তালিকা চূড়ান্ত পর্যায়ে অনুমোদন করেন।
ভিজিডি মহিলা নির্বাচনের শর্তাবলী
- দুঃস্থ মহিলাদের মধ্য থেকে ভিজিডি মহিলা নির্বাচন করা হয় যারা: (ক) পরিবার প্রধান (খ) বিধবা/স্বামীর নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন/স্বামী পরিত্যক্তা / তালাকপ্রাপ্তা (গ) অসুস্থ কর্মক্ষমতাহীন পঙ্গু স্বামীর স্ত্রী।
- পূর্বের ভিজিডি কার্ডধারিণী কোন মহিলাকে নতুন করে নির্বাচন করা যায় না।
- একটি পরিবার মাত্র একটি ভিজিডি কার্ড পায়।
- যিনি অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের কর্মসূচি বা দলের আওতাভূক্ত যেমন-আর এম পি এবং এনজিও গ্রুপের সদস্যা, তিনি ইউপি ভিজিডি কর্মসূচীর সুবিধা পান না।
নির্বাচিত মহিলাদের দুঃস্থতার মাপকাঠি
- ভূমিহীন অথবা ০.৫০ একরের চেয়ে কম জমির মালিকানা
- যে সমস্ত মহিলার আয় অনিয়মিত, অতি সামান্য, অথবা কোনরকম পারিবারিক ব্যবস্থা নেই (মাসিক ৩০০ টাকার চেয়ে কম)
- দিনমজুর বা সাময়িক মজুর
- উৎপাদন করে আয় করা যায় এমন কোন সম্পদ নেই যার।
উপরোক্ত একটি বা একাধিক শর্তপূরণকারী মহিলাকে তালিকাভুক্ত করা যায়, তবে নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন প্রশিক্ষণযোগ্য মহিলারা অগ্রাধিকার পাবেন:-
- দৈহিকভাবে যোগ্য
- অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে সক্ষম
- দলগতভাবে কাজ করতে আগ্রহী।
ইউনিয়ন ভিজিডি কমিটি
ইউনিয়ন পর্যায়ে ভিজিডি কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও পরিচালনা করে ইউনিয়ন ভিজিডি কমিটি। এই কমিটি যে কাজগুলো করে:
- নিয়মিতভাবে মাসিক সভা করে।
- নির্ধারিত শর্ত মোতাবেক ভিজিডি মহিলাদের সঠিকভাবে বাছাই করে।
- গমের সঠিক বিতরণ নিশ্চিত করে, বিশেষ করে ভিজিডি মহিলারা যাতে মাসিক ৩০ কিলোগ্রাম খাদ্য রেশন পায় সেই বিষয়টি দেখে।
- নির্দিষ্ট বিতরণ তারিখেই যেন খাদ্য বিতরণ করা হয় এবং সঠিকভাবে যেন সব রেকর্ড (মাস্টার রোল, মজুদ রেজিস্ট্রার, সঞ্চয় রেজিস্ট্রার, পরিদর্শন বহি) সংরক্ষণ করা হয় তা নিশ্চিত করে।
- সহযোগী বেসরকারি সংস্থাকে প্রয়োজনীয় সমর্থন প্রদান এবং উন্নয়ন প্যাকেজ সেবা প্রদানে তাদের সার্বিক সহযোগিতা দেয়।
- যে ইউনিয়নে বেসরকারি সংস্থার উন্নয়ন সহযোগী অথবা দলনেত্রী সম্প্রসারণ কর্মী নেই সে সমস্ত ইউনিয়নে ভিজিডি মহিলাদের মধ্যে সামাজিক সচেতনতা বাড়ানোর জন্য বিশেষ সভার আয়োজন করে।
- খাদ্যপণ্যের নিরাপদ এবং সঠিক গুদামজাতকরণের বিষয়টি নিশ্চিত করে।
- ইউপি কেন্দ্রে সাইনবোর্ড স্থাপন এবং ঐ সাইনবোর্ডে কেন্দ্রের নাম, ভিজিডি মহিলার মোট সংখ্যা, খাদ্য রেশনের পরিমাণ, বিতরণ তারিখ, প্রত্যেক মহিলার বাধ্যতামূলক মাসিক সঞ্চয়ের পরিমাণ (২৫ টাকা) এবং ভিজিডি খাদ্যচক্রের মেয়াদকাল স্পষ্টভাবে লেখার ব্যবস্থা করে।
- খাদ্য বিতরণের পরবর্তী মাসের ৫ তারিখের মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানগণ যাতে মাসিক অগ্রগতি প্রতিবেদন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট পেশ করেন সে ব্যাপারে নিশ্চয়তা বিধান করে।
ভিজিএফ কর্মসূচি
দুস্থদের খাদ্য সহায়তা প্রকল্প বা ভিজিএফ একটি অনিয়মিত খাদ্য সহায়তা কর্মসূচী। বন্যা,খরা,ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারনে কোন এলাকায় খাদ্যের অভাব দেখা দিলে সেখানে ক্ষতিগ্রস্থ ও অভাবগ্রস্থ পরিবারকে ভিজিএফ কার্ডের মাধ্যমে সাময়িকভাবে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়।
গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) কর্মসূচি
বর্ষাকালে বাংলাদেশের গ্রাম এলাকায় জনসাধারণের কাজের সুযোগ কমে যায়। এই সময়ে যারা বেকার হয়ে পড়েন তাদের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে খাদ্য সহায়তা প্রদানের জন্য রয়েছে গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) কর্মসূচী। রাস্তা/রাস্তা কাম বাঁধের সংস্কার,বাঁশের সাঁকো তৈরি,নালা-নর্দমা খনন ও পুনঃখনন,বৃক্ষরোপণ,শিক্ষা/ধর্মীয় ও অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন করা হয় এই কর্মসূচীর মাধ্যমে। এই কর্মসূচীর প্রত্যেক প্রকল্পের জন্য সর্বোচ্চ ৬ মেট্রিক টন গম/চাল বরাদ্দ করা হয়।
পল্লী রক্ষণাবেক্ষণ কর্মসূচী (আরএমপি)
পল্লী রক্ষণাবেক্ষণ কর্মসূচীর মাধ্যমে গ্রামীণ দুস্থ মহিলাদের দ্বারা মাটির রাস্তা চলাচলের উপযোগী রাখা হয়। এই কর্মসূচীর ১০% খরচ বহন করে ইউনিয়ন পরিষদ। পল্লী রক্ষণাবেক্ষণ কর্মসূচীর আওতায় সারা বছরই রাস্তা মেরামতের বিনিময়ে গ্রামীণ দুস্থ মহিলাদের খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়।
সচরাচর জিজ্ঞাসা
প্রশ্ন ১:ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে কি কি খাদ্য সহায়তা কর্মসূচী বাস্তবায়িত হয়?
উত্তর: ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে কাজের বিনিময়ে খাদ্য,ভিজিডি,ভিজিএফ,টি আর, আরএমপি কর্মসূচী বাস্তবায়িত হয়।
প্রশ্ন২: কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য কারা দায়বদ্ধ থাকেন?
উত্তর: প্রকল্প কমিটির চেয়ারম্যান একক এবং সদস্যরা যৌথভাবে দায়বদ্ধ থাকেন।
প্রশ্ন ৩: ভিজিডি সুবিধা পাবেন কোন মহিলারা?
উত্তর: ভূমিহীন অথবা ০.৫ একরের কম জমির মালিক,আয় অনিয়মিত,মাসিক আয় ৩০০টাকার কম,দিনমজুর বা সাময়িক মজুর এবং আয় করার সম্পদ নেই এমন মহিলারা।
প্রশ্ন ৪: বন্যা,খরা,ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয় কিভাবে?
উত্তর: ভিজিএফ কর্মসূচীর মাধ্যমে বন্যা,খরা,ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়।